নিপুণ চন্দ্র, দশমিনা প্রতিনিধি:
"আর ভাল রাগেনা, ঝোলা আমারে নিয়া যা" অদূরের গোগলাপাতার ঝুপড়ি থেকে ভেষে আসে ক্লান্ত সালেহার কথা। হোগলাপাতা কাঁটা আর শুকিয়ে বিক্রির অর্থ থেকে ২৪টি বছর টেনে-হিঁচরে চালে আসছে সালেহার পরিবার। স্বামী হানিফ জোমাদ্দার এর গতরে এক সময় মর্দের শক্তি ছিল। দু'এক বেলা আর অর্ধাহার-অনাহারে অনেক আগেই বুঁেড়া হয়ে যায়। বয়স আর অসুস্থ্যতায় ন্যুজ হানিফ জোমাদ্দারই সালেহার বোঝা। দৈর্ঘ্য বছরেরও স্বামীর শ্রদ্ধাটুকু কমে যায়নি বলেই সন্তান পরিত্যাক্ত হয়েও স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখে সালেহা। ডালিম, আলাউদ্দিন ও আনোরা যুববয়সী ৩ সন্তানই বিয়ে হয়েছে। ডালিম ৪ সন্তানের জননী হয়ে স্বামীর সাথে ঘর করছে। জেলে নৌকার কাজ করা আলাউদ্দিনেরও ৪ সন্তান আর স্ত্রীর খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তাই মাকে ছেড়ে অন্যত্র থাকেন। আনোরার এক কন্যা সন্তান। কন্যা সন্তান প্রসাবের জন্য স্বামী তালাক না দিলেও দ্বিতীয় বিয়ে করা সংসারে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলেনি আনোরার। তিন বছর পূর্বে কন্যা শিল্পিকে মায়ের কাছে রেখে আনোরা ঢাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ করে। শিল্পি অনেকদিন হলদে-পালন রোগে ভুগে মারা যায়। ওঝা-কবিরাজ দেখানো হয়েছে নিয়মিত ঝাড়-ফুক দেয়া হয়েছে তবুও নাতিনকে বাঁচাতে পারেনি সালেহা। ঈদে আনোরা ক্যনাকে দেখতে আসে। মেয়েকে কিভাবে জানাবে এ কথা তাইতো সালেহা অভিমানে ঝোলা নামের কোন প্রেতাত্মা কর্তৃক নিজের মৃত্যু চায়।
পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার সর্ব দক্ষিণে চরশাহজালালের অবস্থান। এ চরে ১২৫টি বাড়িতে রয়েছে ১৪৫টি পরিবার। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ কৃষক-কৃষাণী ফেডারেশন এর আন্দোলনে ভূমীদস্যুদের ভীরে এই চরে যায়গা করে নেয় উপজেলার নদী ভাঙ্গন কবলিত ভূমিহীনরা। প্রায় দু'যুগ প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর ভূমিদস্যুদের সাথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেও এখানকার মানুষ ভালো থাকার উপায় বের করতে পারেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয়জল, খাসজমি বন্দোবাস্তর নামে হয়রানি থেকে শুরু করে হাজারো সমস্যায় চরবাসীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। এসব সাইকেল সমস্যা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারছেনা। চারদিকেই ভূমিদস্যু, ভূমি দালালরা ঘুর ঘুর করছে। সুযোগ পেলেই খাস জমির আশ্বাসে ভূমিহীনদের শেষ অর্থও হাতিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতায় থাকা সরকারের এসব কুশীলব পুত্ররা। যে দিকে ক্ষমতা সেদিকে ছুটে ওরা। কিন্তু ওদের কপালে জুটে না এক টুকরো জমি। চরবাসীদের দুরাবস্থা ইদানিং এতটাই বেড়েছে যে অনেকেই দু-বেলা খাবার পর্যন্ত যোগার করতে পারছে না। এদেরই একজন সালেহা। সরেজমিনে চরবাসীর এ করুন চিত্র বেড়িয়ে এসেছে।
উপজেলা পূর্বকোল ঘেঁষে বয়ে গেছে প্রমত্তা তেতুঁলিয়া-বুড়াঁগৌরাঙ্গ নদী। একই নদী দু'নামে নাম করণ করা হয়েছে। এর ঠিক মাঝখানে জেগে উঠেছে ছোট-বড় দ্বীপ। সর্ব দক্ষিনে চরশাহজালালের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে ট্রলার কিংবা নৌকা ছাড়া এ চরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ১/৫ ঘন্টা যেতে সময় লাগলেও আবহাওয়া খরাপ থাকলে যাওয়ার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। চরশাহজালালে ১২৫টি বাড়িতে রয়েছে ১৪৫টি পরিবার। জনসংখ্যায় পুষ্ট পরিবারগুলোতে প্রায় সাড়ে ৯শ লোকের বাস। ১৯৮৮ সালে বসতি স্থাপন করা এসব ভূমিহীন লোকজনের একটাই দাবী, সরকারী খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া। চরে বিপুল পরিমান খাস জমি থাকলেও ভূমিহীনদের কপালে তা জুটে না। চরে বসবাসরত ভূমিহীনরা অভিযোগ করে বলেন, এখানকার প্রায় সকল খাস জমি দশমিনা, গলাচিপা, বাউফল উপজেলার একশ্রেনীর বিত্তবান ও ভূমি দস্যুরা ১৯৮২-৮৩ সালে নামে বেনামে বন্দোবস্ত নিয়েছে। সরেজমিনে কথা হয় এ চরের কৃষক মুক্তিযোদ্ধা আঃ খালেক খান এর সাথে। খালেক খান জানান, গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নের আলাউদ্দিন গং দেড়শ একর, চর বিশ্বাসের রাজ্জাক, শাহ আলম ও সাজু মৃধা ১শত একর, মুক্তার হোসেন মাল ১শত একর, বাউফল উপজেলার বাসিন্দা দশমিনার রনগোপালদি তহশীলদার আঃ রাজ্জাক দেড়শ একর, দশমিনা উপজেলার পাতার চরের আনসার সরদার ও মোসলেম সরদার ৮০ একর, আবুল রাড়ী প্রায় দেড়শ একর জমি নামে বেনামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। এসব প্রভাবশালী ভূমি খাদকরা প্রায় সাড়ে ৮শত একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। এভাবেই প্রায় গোটা চরের জমি প্রভাবশালী ভূমি খাদকরা গ্রাস করে রেখেছেন। ১৯৯২ সালে বাকৃফে সংগঠনের প্রায়াত নেতা আঃ ছাত্তার খান এর নেতৃত্বে ভূমিখাদকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-মামলা শুরু হলে আপোষ বন্টনে এসব ভূমিখাদরা ১২৫শতাংশ জমি প্রতি ভুমিহীনকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও আলোর মূখ দেখেনি। ভূমিহীনদের নেতৃত্ব দেয়া মুসা খা, ফোরকান হাং, আশ্রাফ শিং, ইসমাইল হাং ও কালাম হাং দেড় একর করে বন্দোবস্ত পেলেও এ চরের ১৪০ ভূমিহীন নয্যতা থাকলেও আজও নিজের করতে পারেনি বসবাসরত ভূমিটুকু। এসব ভূমিহীনদের অনেকে অভিযোগ করে বলেন, কিভাবে এসব প্রভাবশালীরা এক একজনে বিপুল পরিমান জমি দখল করে রেখেছেন এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মন ধান নিজেদের গোলায় তুলছে তা স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা আজ পর্যন্ত তলিয়ে দেখেনি। যদি কখনো ব্যাপক তদন্ত করা হয় তাহলে প্রভাবশালীদের সীমাহীন জালিয়াতির অনেক তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। নদী ভাঙ্গা, সর্ব হারা মানুষরা পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে এসব চরে। ভূমিহীন মানুষের নিত্যকার জীবনও কঠোর রুক্ষতায় ভরা। প্রতিনিয়ত হাজারো প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। এখানে জীবন ধারনের ন্যুনতম কোন সুবিধা নেই। নেই কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা নেই। বুড়াঁগৌরঙ্গ নদী ও খালের পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটাতে হয়। শিশুদের কপালে জুটেনা লেখাপড়া শেখার সুাযোগ। শিক্ষা ক্ষেত্রে এসবচরে বৈষম্যর শিকার হচ্ছে বর্তমানেও। এখানকার প্রতিটি নারী এক একটি বন্দী পাখি। দিন রাত খেটেও পায় না নিস্তার। হাজারো কঠোর শৃঙ্খলে তারা বাঁধা পড়ে আছেন। ১১/১২ বছর বয়সের কিশোরীদের যেতে হয় অন্যের ঘরে বধু সেজে। এ চরে ঘরে ঘরে কিশোরী বধুরা। এখানে চিকিৎসা নেয়ার মত কোন ব্যবস্থা নেই। ঝাড় ফুক এর উপর নির্ভর করতে হয় গোটা চরের মানুষের। এচরের কোন বাসা বাড়িতে নেই সার্বিক স্যানিটেশন কিংবা স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানার ব্যবস্থা। ছোট বড়, নারী-পুরুষ সকলেরই ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে কিংবা চরের খোলা ময়দানে অথবা খালের পাড়ে প্রাকৃতিক এ কাজটি সারে। চরের চারপাশে নেই বেড়িবাধ। ফলে বর্ষা মৌসুমে চরবাসির থাকতে হয় পানি বন্দী অবস্থায়। বর্ষাকালে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে যাওয়ার কোন উপায় থাকে না। এ সময়ে কর্ম সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে অনেকের অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হয়। এসব ভূমিহীন পরিবার একটুক ভাল থাকার তীব্র আকাঙ্খায় বছরের পর বছর এ ধরনের সমস্যায় আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা পড়ে নায্য দাবীটুকু বাস্তবায়ন না দেখে সংসার নামক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য প্রেতাত্মা কিংবা শ্রেষ্টার কাছে সালেহার মতো মৃত্যু কমনা করেন।**